Thursday, 2 February 2017

বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট শেখ শামসুল ইসলাম-এর জীবনী :-




বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট শেখ শামসুল ইসলাম-এর জীবনী :-


বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট শেখ শামসুল ইসলাম যশোর জেলা শহরের পি.টি.আই রোডস্থ সম্ভ্রান্ত্ম মুসলিম পরিবারে পৈত্রিক বাড়িতে পহেলা জানুয়ারী ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম শেখ গোলাম সরোয়ার, পিতা একজন ভূস্বামী ও পরে যশোর জজ কোর্টের পেশকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মাতার নাম মরহুম রিজিয়া সরোয়ার।
শেখ শামসুল ইসলাম যশোর শহরস্থ পি.টি.আই.সরকারী প্রাইমারী স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণী, যশোর সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে যশোর বোর্ডের অধীনে অধিকাংশ বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে ১৯৭২ সনে এস.এস.সি.পাশ করেন। নটরডেম কলেজ থেকে অধিকাংশ বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে ১৯৭৪ সনে ঢাকা বোর্ডের অধীনে এইচ.এস.সি. পাশ করেন। তিনি ১৯৭৫ সনের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেভেনলং কোর্সে ভর্ত্তি হন। ১৯৭৫ সনে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের পর মায়ের নির্দেশে সেনাবাহিনীর ট্রেনিং সমাপ্ত না করে চলে আসেন, মা পুনরায় পড়াশুনা শুরম্ন করতে বলেন। এরপর ডিগ্রিতে ভর্ত্তি হন এবং যশোর সিটি কলেজ থেকে ১৯৭৯ইং সনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সাথে সাথে যশোর পলিটেকনিক্যাল কলেজে ভর্ত্তি হয়ে বৃত্তি প্রাপ্ত হন ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপেস্নামা কোর্স সমাপ্ত করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞানে মাস্টার্সে ভর্ত্তি হয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৩ইং সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন যশোর শহীদ মশিয়ুর রহমান ল'কলেজ থেকে এলএল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ৩ মার্চ ১৯৮৫ ইং সনে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইন পেশা পরিচালনার সনদ প্রাপ্ত হয়ে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করে আইন পেশা শুরম্ন করেন। ১৯ মে ১৯৮৯ ইং সনে তিনি এশিয়ার বৃহত্তম আইনজীবী সমিতি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা মেট্রো বার আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ গ্রহণ করেন ১৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ ইং সনে।
তিনি ১৯৯০ ইং সনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানাধীন মরহুম নাজমুল কাউনাইন জমজম মিয়ার চতুর্থ কন্যা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত্ম সচিব, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও পরবর্তীতে জাসদ নেতা কাজী আরিফের ভাগ্নি তাসলিমা সুলতানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মিসেস তাসলিমা আক্তার আলমডাঙ্গা বাদে মাজু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিÿিকা হিসাবে কর্মরত। তিনি দুই পুত্র সন্ত্মানের জনক, প্রথমপুত্র শেখ মুক্তাদির ওয়ার্ল্ড বিশ্ববিদ্যাল, ঢাকায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ও দ্বিতীয়পুত্র আলমডাঙ্গা স্কুলে ৭ম শ্রেণীর ছাত্র।
তিনি ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ১৯৬৮ সনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৬৯ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে খান টিপু সুলতান এবং মনি ভাইয়ের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগদান করে'৬৯ সনের গণ অভ্যূত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চে যশোর ক্যান্টমেন্টে পাক-সেনাদের তৎকালীন ই.পি.আর ও পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় সাংসদ রওশন আলী এবং এডভোকেট মরহুম নুরম্নল ইসলামের নেতৃত্বে পাক-হানাদারদেরকে সর্বাত্বক প্রতিহত করায় অংশ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পাক-সেনারা যশোর নিয়ন্ত্রণে নিলে তিনি পায়ে হেঁটে পরিবারের সাথে মাগুরায় মামার বাড়ি যান। সেখান থেকে জুন মাসের কোন এক সময়ে মাগুরা ঝিনাইদহের মহেশপুরের বর্ডার দিয়ে ভারতের ২৪ পরগণা জেলার কাদিহাটী যুব শিবিরে আশ্রয় নিয়ে সেখানে ক্যাম্প কমান্ডার আমজাদ চেয়ারম্যান, কাশিয়ানী,ফরিদপুরের নিকট রিপোর্ট করেন এবং ট্রেনিং শুরম্ন করেন। আমজাদ চেয়ারম্যানের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার কাশিয়ানী থানায় এবং সম্পর্কে তাঁর মামা। কাদিহাটী যুব শিবিরে ভারতের সেনাবাহিনীর কমান্ডার জগজীবন রাম ট্রেনিং দান করেন। এক মাসের গেরিলা ট্রেনিং শেষে তাঁদের ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ইউনিট কমান্ডার নাজমুলের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নড়াইল হয়ে ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়া। ভাটিয়াপাড়া এসে ১১ নং সেক্টরে মেজর হুদার অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা ভাটিয়াপাড়া পাক-আর্মীদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন জুলাই মাসের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায়, সেই যুদ্ধে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা মরহুম হেমায়েতের নেতৃত্বে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। সেই যুদ্ধে পাক-হানাদার ৫ জন ও ২৫ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাক-হানাদারদের ক্যাম্পটি ধ্বংশ হয়, গোলা বারম্নদ সহ মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটি দখলে নেয়। ১৫ দিন পর পুনরায় পাক হানাদাররা শক্তি বৃদ্ধি করে ক্যাম্পটি তাদের দখলে নেয়। তখন রাজাকারদের উৎপাতবৃদ্ধি পায়, তারা গ্রাম-ছে-গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ফলে রামনগর সহ সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে হিন্দু-মুসলমান শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
আগস্টে কালিয়া থানা রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ১০/১২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, সেই আক্রমণে তিনি সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন।
তিনি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ষ্টেনগান ও থ্রি নট থ্রি চালাতেন বলে জানান এবং গ্রেনেড হামলা করতে প্রশিÿণ প্রাপ্ত ছিলেন। এরপর পুনরায় ভারতে মুজিববাদী ট্রেনিং-এর জন্য তাঁকে পাঠানো হয়। আসামের দেরায় যাওয়ার কথা ছিল, অল্প বয়স বিধায় তাঁকে আর আসামে পাঠানো হয়নি। ২৪ পরগণায় কল্যাণে মুজিব বাহিনী হিসাবে উচ্চ পর্যায়ের গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করে নভেম্বরের প্রথম দিকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, বাংলাদেশে এসে পুনরায় ১১ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন, যশোর শহর সহ আশেপাশের থানায় বিভিন্নযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। পাক-আর্মীদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলতে সÿম হন। একদিন সন্ধ্যার দিকে টি এন্ড টি রাজাকার ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলায় অংশ গ্রহণ করেন। ডিসেম্বরের ৫/৬ তারিখের দিকে যশোর থেকে খুলনার দিকে যেতে ৫ মাইল দূরে রামনগরে পাক-হানাদাররা সরে যাওয়ার পথে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে আক্রমণ করেন, সেইযুদ্ধেও তিনি মিত্রবাহিনীর সাথে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে বহু পাক-হানাদার হতাহত হয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর স্বাধীনতা লাভ করে, পাক-হানাদাররা পায়ে হেঁটে খুলনার দিকে যেতে নোয়াপাড়া জুট মিল ও পিপলস জুট মিলে ক্যাম্প করে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্ত্মানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যশোরে প্রথম পদায়ন করিলে তিনি সহ ২০০ মুক্তিযোদ্ধা গার্ড অব অনার প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু তসবির মহলে সবাইকে ডেকে নিয়ে বলেন যাদের লেখাপড়ার বয়স আছে, তাহারা পড়াশুনা শুরম্ন কর, আমার দেশ গড়ার জন্য অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিষ্টার দরকার। সেই দিন রওশন আলী এম.পি-এর সাথে থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর করমর্দন করার সুযোগ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সকলে অস্ত্র জমা দেন চাচড়ার মিলিশিয়া ক্যাম্পে।
তাঁর পরিবারের চার ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বড় ভাই হলো মরহুম মুক্তিযোদ্ধা শেখ সিরাজুল ইসলাম, তিনি পরবর্তীতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মেজো ভাই মরহুম মুক্তিযোদ্ধা শেখ নুরম্নল ইসলাম এবং ছোট ভাই শেখ আলতাফুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় সে হারিয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাকে পাওয়া যায়।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট বিশ্ব ইতিহাসের নির্মম হত্যাকান্ড জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে শহীদ হওয়ার খবর তিনি নটরডেম কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সকালে শুনেন। তখন শোকে বিহবল হয়ে ওঠেন। ফজর নামাজ পড়েন, নামাজ পড়ে পরম করম্নণাময় আলস্নাহ তালার কাছে জাতির জনক সহ পবিবারের সকলের রম্নহের মাগফিরাত কামনা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তখন তিনি ঢাকার আরামবাগ এলাকায় থাকতেন। বাসার বাহির হয়ে দেখেন সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে বঙ্গভবন ঘিরে রেখেছে।
তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জেয়ারতে দুই বার গিয়েছেন। সব সময় যেতে মন চায়। তাঁর ভারত ছাড়া আর কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। দেশে কঙ্বাজার, সুন্দরবন সহ অনেক জেলা ভ্রমণ করেছেন।
তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন বার এসোসিয়েশনেরও সদস্য। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ডঃ এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। যশোর রোটারেক্ট ক্লাবের চার্টাড প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মতিঝিল রোটারী ক্লাবের সদস্য ছিলেন, অনুসন্ধানী বিজ্ঞানী ক্লাব যশোরের পরিচালক ছিলেন। তিনি খেলাধুলা পছন্দ করেন। একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ঢাকা আইনজীবী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি নবীন মাছ চাষী সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাছ চাষ করতেন ৪০০০ একর হাওড় এলাকা নিয়ে। কৃত্রিম মাছের প্রথম হ্যাচারীর উদ্যোক্তা এবং গরীবদের পুনর্বাসনের একজন উদ্যোক্তা।
সাক্ষাৎকারটি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং গৃহীত।

No comments:

Post a Comment